ধারাবাহিক উপন্যাসঃ নাইয়র (পর্ব-নয়)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৫:২৫:০০ বিকাল
ইন্দেরহাট নামের একটা যায়গা রয়েছে। শ্রীরামকাঠী থেকে লঞ্চে গেলে কয়েক ঘন্টার পথ। তবে ঘুরে বাই-রোডেও যাওয়া যায়। সেখানে একটা কাঠের মোকাম গড়ে উঠেছে। নদীতে ভাসিয়ে কিংবা নৌকার পাশে বেঁধে বিভিন্ন যায়গা থেকে সেখানে কাঠ নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবহন খরচ মোটামুটি কমই পড়ে। এক ধরণের মধ্যস্বত্বভোগী যাদেরকে ফড়িয়া বলা হয়, এরা বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে পছন্দসই গাছ অল্প টাকায় কিনে নেয়। আর গাছ মালিকেরাও নিজেদের ঘরে বসে সহজেই টাকা পাওয়াতে এভাবে কম মূল্যে বিক্রি করতেও দ্বিধা করে না। ফলে নির্বিচারে গাছ ধ্বংস হচ্ছে। আর সেই অনুপাতে গাছ লাগানো হচ্ছে কম।
সেদিন কবি মুজিবরের ক্লাব ঘরটিতে বসে বসে পারুল ভাবনার দিগন্তে হারিয়েছিল। অনেক মানুষের শোরগোল ওকে ওর ভাবনার জগত থেকে টেনে নিয়ে আসে। দরোজা দিয়ে বের হয়। দেখে খালের পাড়ে দশ-বারোজন লোক। সবাই পরিচিত। একজন অপরিচিত লোকের নির্দেশে তারা বিশাল এক কড়ই গাছকে দড়ি বেঁধে টেনে খালে নামাচ্ছে। বিশাল গাছটিকে পারুল চিনতে পারে। সে আর মুজিবর এই গাছের ছায়ায় বসে কত সময় কাটিয়েছে। এর বয়স ২৫-৩০ বছর তো হবেই। ব্যাপারি বাড়ি ঢুকতেই রাস্তার পশ্চিম পাশে ছিল এই গাছটি।
একটু মন খারাপ হয়ে যায়। হৃদয়ে কেমন যেন একটু চিনচিনে ব্যথাও অনুভব করে পারুল। দীর্ঘদিনের সঙ্গী ছিল এই গাছটি ওর। সেই একেবারে ছেলেবেলা থেকেই ওর সাথে সখ্যতা। কত রান্না-বাটি খেলেছে গাছটির শিকড়ের কাছে। আজ সেই শিকড় উপড়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চেরাই করার জন্য। ফড়িয়া লোকটিকে কেন জানি পারুলের অসহ্য লেগে উঠে। সে মুখ ঘুরিয়ে বিপরীত দিকে হাঁটা শুরু করে।
বিকেলে মোতাহারকে নিয়ে ওদের তিনজনের মন্ত্রণা সভা বসে। পারুল একটা নতুন প্রস্তাব করে। সে বলে, ' যে হারে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, সেটা খুব আশংকাজনক। এলাকার মানুষ ইদানিং ফড়িয়াদের কাছ থেকে নগদ টাকার লোভে প্রয়োজন না হলেও গাছ বিক্রী করে দিচ্ছে। কিন্তু সেই হারে গাছ লাগানো হচ্ছে না। একটা গাছ কাঁটার আগে অন্তত অন্য আর একটি গাছ লাগিয়ে নেয়া উচিত। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করা প্রয়োজন।'
মোতাহার একটা বিকল্প প্রস্তাব দেয়। সে বলে, ' আমরা পুরো গ্রামকে ঘিরে প্রধান রাস্তার পাশে এবারে গাছ লাগাবো। যার যার বাড়ির সামনের রাস্তার গাছ তাঁরা নিজ দায়িত্বে রক্ষণাবেক্ষণ করবে। গাছের চারার দাম আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ দিবে। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে গাছ বিক্রী করে যে টাকা পাওয়া যাবে, তার ৬০%-৪০% মালিক-ইউনিয়ন পরিষদের ভিতর ভাগাভাগি হবে। এতে করে গ্রামে বনায়নও হলো, মানুষ আর্থিকভাবে লাভবানও হবে। পরিবেশগত ভারসাম্যও বজায় রইলো। কি বল তোমরা?'
পারুল বলে, ' হ্যা, ভালো উদ্যোগ। তবে এই ব্যাপারটা লিখিত ভাবে চুক্তি করে নিতে হবে। সেবার মঠবাড়িয়ায় ওয়াপদার রাস্তায় এরকম বনায়ন করার পরে বেশ বড় ধরণের এক ঝামেলা বেঁধেছিল। যা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তাই সবাইকে নিয়ে যা করবার আগেই ক্লীয়ার করে সমঝোতার ভিত্তিতে করতে হবে।'
মুজিবর সবসময়ই চুপচাপ থাকে। কথাও বলে ওদের সবার পরে। সে বলল, ' প্রধান রাস্তা বনায়নের আওতায় এনে পরবর্তীতে আমরা শাখা রাস্তাগুলোতেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে পারি। তবে সেটা সম্পুর্ণ ব্যক্তিগত যায়গা হওয়াতে ঐখানে ইউনিয়ন পরিষদ ভর্তুকি দিবে। সে যায়গায় গাছ সরবরাহ করলেও কোনো রকম শেয়ার দাবী করবে না পরিষদ। তবে এটা হবে সেকেন্ড স্টেজে। এখনই এটা আলোচনা করা যাবে না। তাহলে মূল রাস্তার ব্যাপারেও মালিকেরা ১০০% শেয়ার দাবী করে বসবে।'
তিনজন তরুন তাঁদের জন্মস্থানকে চিরসবুজ করার একটি স্কীম নিয়ে আগাতে থাকে। ওদের হৃদয়ে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি এক অভাবনীয় ভালবাসার জন্ম হয়। এক একটি ভালোবাসা বয়োঃপ্রাপ্ত হলেই আর একটি ভালবাসার ভ্রুণ চলে আসে। ওরা আশা করে এভাবেই পুরো গ্রামটি একটি কানায় কানায় ভালোবাসাপুর্ণ এলাকায় পরিণত হবে। তখন ঘুণে ধরা সমাজ বলতে কিছু থাকবে না... দুষ্ট চক্র বিলীন হয়ে যাবে ... সালিস বিহীন এক গ্রাম্য সমাজ কায়েম হবে... শোষক ও শোষিত এক কাতারে থেকে হবে সাধারণ মানুষ... এ সবই ওদের হৃদয়ের চাওয়া-পাওয়া। হয়তো এর সবগুলোই কখনো পুর্ণ হবে না। কিন্তু নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে বলতে তো পারবে, তোমাদের বাসযোগ্য এক জন্মভূমি করে দিতে আমরা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমরা ব্যর্থ হয়েছি... এখন তোমরা আরো শক্ত ভাবে শুরু করো। সেই সময় উত্তরপুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে ওদের চোখে চোখ রাখার মত সাহস অন্তত পাওয়া যাবে। মাথা নিচু হবে না।
এক মাস পর...
আজ সবার ভিতরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। বাজার থেকে একেবারে নাজিরপুর পর্যন্ত দীর্ঘ পথের দু'পাশে গাছ লাগানো হচ্ছে। পনের দিন আগে নির্দিষ্ট মাপে গর্ত করে সেখানে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার আর গোবর মিশিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। এতোদিনে সেটা মাটির সাথে মিশে গেছে। এখন সেখানে বিভিন্ন চারা রোপন করা হচ্ছে। এক একটি গাছের সাথে একটি করে বাঁশের খাঁচা। গবাদি পশুদের হাত থেকে গাছকে রক্ষা করার জন্য এই খাঁচার ব্যবস্থা। অবশ্য এর পিছনে বেশ কিছু টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। সেটাও প্রোজেক্টের ভিতরে চলে আসবে। ওদের এই আন্দোলনের নাম দেয়া হছে " এসো সবুজ হই "। বর্ষা মওসুমে এবার ওরা পাঁচ হাজার গাছ লাগাতে যাচ্ছে। শুরুটা এই পরিমান চারা দিয়েই হল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে।
প্রতি বাড়ির একজন ইউনিয়ন পরিষদের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করলো। মালিকেরা গাছ বিক্রির ৬০% টাকা পাবে। ১৫ বছর ব্যাপী এই চুক্তির মেয়াদ স্থির করা হয়েছে। এই পনের বছরে কোনো গাছ কাটা যাবে না। তবে রাস্তার উন্নয়ন-সংষ্কার কিংবা সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য প্রয়োজনে সময়ের আগেই দু'পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে গাছ কাটা যাবে। এভাবে শ্রীরামকাঠী গ্রামে বৃক্ষরোপন কর্মসূচীর উদ্বোধন হল। একটা ব্যাপার পারুলের কাছে বেশ ভালোই লাগলো। তা হল, 'এসো সবুজ হই' প্রকল্পে দুষ্ট চক্রের সবাইও সানন্দে অংশ নিয়েছে। হয়তো এখানে লাভের ব্যাপার রয়েছে বুঝেই তারা এসেছে।
গ্রামের কিছু সাদা-কালো মনের মানুষ সবুজ হবার এক বৈপ্লবিক আন্দোলনে নেমেছে... দেখা যাক ওরা সবাই মিলে কতদূর যেতে পারে!
... ... ...
একটানা আজ দু'দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে।
ঝুম বৃষ্টি। টিনের চালে মন মাতাল করা শব্দে কতক্ষণ আর ঘরে মন টিকে। রাতে ঘুমাবার সময়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া যায়। কিংবা এক দেড় ঘণ্টা এক টানা শব্দ শোনা যায়। তাই বলে ৪৮ ঘন্টা একটানা? পারুলের মনটা হাফিয়ে উঠেছে। এক চঞ্চলা হরিণী সে! ঘরের ভিতরে বন্দী থাকতে কতক্ষণ আর ভালো লাগবে।
নিজের শোবার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টির প্রচন্ড ছাটে বিন্দু বিন্দু তুষার কণার মত পানি শরীরে জমে যাচ্ছে। দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দিচ্ছে। বেশীদূর দেখতে পাচ্ছে না। চোখ যখন বেশী দূর দেখতে পায় না, সেই সময় মন বহু দূরে চলে যায়। ব্রেইনে চিন্তার জাল বুনতে থাকে। কত কিছু মনে পড়ে। সুদূর অতীত কিংবা সাম্প্রতিক অতীত নিয়ে কাজ কারবার হচ্ছে মনের। আর নিকট ভবিষ্যৎ নিয়ে কাজ করে ব্রেইন। এখন অবশ্য পারুল মনকেই কাজে লাগাচ্ছে। গত পরশুদিনের কথা মনে মনে ভাবছে... ... ...
'এসো সবুজ হই' প্রকল্পের গাছ লাগানোর দিনে বিকেল বেলা খালের পাড়ে বসে আছে পারুল। সারাটা দিন খুব ঝই ঝামেলার ভিতর কেটেছে। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ এবং গ্রামবাসীর সাথে গাছের শেয়ারের ব্যাপারে চুক্তির ফটোকপি সে সবাইকে দিয়েছে। যার যার নাম রয়েছে, তাদেরকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে এই কাজটি করে কেবল একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। এই সময়ে এলো ফাতুর মা। সবাই ওকে ফাতুর মা হিসাবেই চিনে। এই নামে ডাকতে ডাকতে ওর আসল নাম কুলসুমা বেগম অনেক আগেই বিস্মৃতির অতলে হারিয়েছে। আজ পারুল চুক্তির কাগজ দিতে গিয়েই না তার আসল নামটি জানতে পেরেছে। ফাতুর মার হাতে সেই চুক্তির কাগজ। পারুলের সামনে এসে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ' মা, একটু পড় দেহি। মুই তো পড়তে পারি না। মোরে পইড়া হুনা।'
ফাতুর মাকে পারুল চুক্তিতে কি লিখা আছে সেটা আগাগোড়া পড়ে শোনায়। বুড়ি খুশী মনে ফিরে যেতে যেতে কি মনে করে আবার পারুলের কাছে ফিরে আসে। জিজ্ঞাসু নেত্রে পারুল তার দিকে তাকায়। ফাতুর মা একটু লজ্জা পায়। একবার পারুলের দিকে তাকায়। একবার নিজের পায়ের নখ দেখে। শেষে বলে, ' মা রে, একখান কতা কই তোরে?' পারুল একটু অবাক হয়। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে উত্তর দেয়, ' বলো খালা।' ফাতুর মা যখন কথা বলে, তখন তার ভিতর থেকে যেন কুলসুমা বেগম বের হয়ে আসে। স্বভাবজাত ভঙ্গীতে কথা না বলে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে সে বলতে থাকে, ' মুই পড়ালেহার সুযোগ পাই নাই। বাপে মোরে আমপারা টুক কোনমতে হিহাইয়া হের দায়িত্ব শ্যাষ করছে। অহন গুরা গারা পোলাপাইন ইশকুলে যায়... দ্যাখতে মোর বড় ভালা লাগে। তাই কইতে চাইছিলাম যে, অগো মত একটা ইসকুল কি মোর মত মুক্ষু সুক্ষু মানুর জইন্য করবার পারো?'
একজন বয়স্ক অশিক্ষিত গরীব মহিলার মুখ দিয়ে যে কথাটা বের হল, আক্ষরিক অর্থে পারুল থ' মেরে গেলো। ওর চোখ বিস্ময়ে গোল হয়ে যায়। অবাক হয়ে ফাতুর মার মুখের দিকে সে অনেকক্ষণ চেয়ে রয়। একটা নতুন ভাবনা নতুন কিছু আনন্দকে সাথে নিয়ে পারুলের ষষ্ঠাঙ্গে খেলা করে। হৃদয়ের গভীর থেকে নতুন কিছু ভালোলাগারা ডালপালা গজায়। পারুল খুশীতে ফাতুর মাকে জড়িয়ে ধরে। সে তার গ্রামের মানুষের ভালোর জন্য আরো একটি ধাপে পা রাখতে যাচ্ছে, এই চিন্তাটাই পারুলকে উত্তেজিত করে তোলে। একই সাথে দুষ্ট চক্রের যে প্রধান অস্ত্র- অশিক্ষা, সেটাকে দূর করার ভিতর দিয়ে সে ঐ চক্রের সাথে আরো একটি লড়াই করতে যাচ্ছে... উত্তেজনা বেড়ে যাবার এটাও একটা কারণ। পারুলের ব্রেইনের কোষে কোষে ইতোমধ্যে বয়স্ক শিক্ষার ব্যাপারে কিছু কার্যকরী প্ল্যান জন্মাতে থাকে। সে মনে মনে মোতাহার এবং মুজিবরকে খুঁজতে থাকে। ফাতুর মা চলে যাবার পরও সে খালের পারে দীর্ঘসময় বসে থাকে। শেষে মোবাইল বের করে মোতাহার ও মুজিবরকে ক্লাব ঘরে আসার জন্য বলে।
একটা দমকা বাতাস বৃষ্টির পানি জানালা দিয়ে ভিতরে ঠেলে দেয়। পারুলের মুখ থেকে শুরু করে শরীরের অর্ধেক ভিজে যায়। বিছানায় আধাশোয়া হয়ে থাকার জন্য বাকি অংশ ভিজতে পারেনি। চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে পারুল বাস্তবে ফিরে আসে। তবে বৃষ্টির অযাচিতভাবে দেওয়া এই শীতল আতিথেয়তায় সে বরং খুশীই হয়। ওর কাছে মনে হয় মুজিবর তার হাত দিয়ে ওর চিবুকের কাছে যে তিলটি রয়েছে সেখানে স্পর্শ করছে! হটাৎ করেই পারুলের সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে। এই বর্ষায় ওর হৃদয়ের ভিতরের অদৃশ্য ফায়ারপ্লেসে শীতল আগুন জ্বলে উঠে। সে কিছুটা নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে থাকে। অনেক দিন পর শরীর তার নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে চায়... স্নায়ুগুলো পরিচিত কিছু উপলব্ধিকে অনুভব করতে চায়। কিন্তু অতীতের সেই অনুভব ছিল খুবই বাজে অভিজ্ঞতায় ভরপুর। একজন নপুংশক এর বিকৃত কর্মকান্ডের কথা মনে পড়তেই কোথা থেকে দুঃখগুলো সব এসে ভীড় করে পারুলের হৃদয়াকাশে। একটু আগের কামনার বাতিঘরে নীল ঢেউ এসে বাতিগুলোকে নিভিয়ে দেয়। পারুল অন্য কিছু নিয়ে চিন্তার স্রোতে ভেসে যেতে চায়। আর বয়স্কদের স্কুলের ব্যাপারটা এই ক্ষেত্রে ওকে উদ্ধার করে।
সেদিন ক্লাব ঘরে বসে মোতাহার এবং মুজিবরকে নিয়ে পারুল বয়স্ক শিক্ষার ব্যাপারে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করে। প্রথমেই পারুল এই প্রজেক্টের নামকরণ করে। সব কাজই সে সুনিপুণ পেশাদারী ভঙ্গীতে করতে চায়। এজন্যই এখন পর্যন্ত গ্রামে ওরা টিকে আছে। যে ক'টি কাজে হাত দিয়েছে, সব দিক ভেবে চিন্তে তারপর মাঠে নেমেছে। আর সাথে রেখেছে 'তৃণমূল মানুষের' এর সমর্থন। হৃদয়ে প্রচন্ড ভালো কিছু করার একাগ্রতা, পেশাদারী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বস্তরের জনগনের সাহচর্য- এই তিনটি জিনিস পারুলদের রয়েছে... এটাই ওদের বিশাল শক্তি।
সন্ধ্যার পরে কলতান কিন্ডারগার্টেনেই বয়স্কদের শিক্ষাদান কর্মসূচী শুরু করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হল। প্রকল্পের নাম দেয়া হল, ' বিকশিত শ্রীরামকাঠী'। পুরুষ এবং মহিলাদেরকে আলাদা ভাবে ভিন্ন রুমে হাতে খড়ি দেয়া হবে। কারণ দুষ্ট চক্র যেন এই ভালো কাজটিতে নারী-পুরুষের একত্রে মেলামেশার অজুহাতটিকে নেগেটিভ ভাবে দাঁড় করাতে না পারে। এজন্য পারুল মহিলাদেরকে শিক্ষা দিবে। মুজিবর শিখাবে পুরুষদেরকে। এ ব্যাপারে অন্যান্য সকল খুঁটিনাটিসমূহ আলোচনা করা হল। পরেরদিন মোটামুটি ভাবে একটি সভার আয়োজন করে এলাকাবাসীর মতামত জেনে নেয়া হবে। সকলের সমর্থন নিয়েই এই কাজে নামতে হবে।
আবার বাস্তবে ফিরে আসে পারুল। আজ দুইদিন একটানা বৃষ্টির জন্য সভার আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। মোবাইলে মোতাহারের সাথে কথা হয়েছে দুপুরের দিকে। আর মুজিবর সকালে একবার বাড়ীতে এসে দেখা করে গেছে। সবাই বৃষ্টি বন্ধ হবার অপেক্ষায় রয়েছে। এখন দেখা যাক শ্রাবণ মাসের এই ভরা বাদল আর কতটা দীর্ঘায়িত হয়।
সে মোবাইলের মেমোরিতে লোড করা গানের ভিতর থেকে বেছে প্রিয় একটা গান ছাড়ে। জানালার শিকে কপাল ঠেকিয়ে দুইহাত গালে রেখে দুই কনুইয়ের উপর ভর রেখে নিবিষ্ট মনে গান শুনে পারুল! শ্রাবণের ঝুম বৃষ্টি... দমকা বাতাসের সাথে গাছেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের জোর শব্দ... টিনের চালে একটানা সুর তুলে মেঘবালিকাদের কান্না- এসব কিছু মিলিয়ে পারুলের হৃদয়ে এক অপার্থিব অনুভূতি জেগে উঠে। সে চোখ বুজে সেই ভালোলাগাটুকুকে উপভোগ করতে থাকে। একজন অতৃপ্ত রমণী সব দিক থেকে জীবনের কাছে হেরে আবার শুন্য থেকে সব শুরু করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে।
শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিমূখর এক বিকেল ওর সকল দুঃখের প্রদীপ নিভিয়ে সেখানে এক রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলকে আনার চেষ্টা করে। নারী... প্রকৃতি... এ দুইয়ের মাঝে এক বিশেষ মিল রয়েছে। সেটা হচ্ছে সহ্য ক্ষমতা। উভয়েরই সহিষ্ণুতা অত্যধিক। তাই প্রচন্ড যন্ত্রনাকে হৃদয়ে বয়ে বয়ে যখন আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা, তখন নারী প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করে। প্রকৃতি পরম মমতায় নিজের কোলে টেনে নেয়। নিজের ভিতরে ধারন করা সহিষ্ণুতা অকৃপণভাবে ঢেলে দেয় নারীর বুকে। তাই তো নারী আবারও হাসিমুখে ফিরে আসে শত সহস্র যন্ত্রনার আধার এই সংসারে।
পারুলের মোবাইল বেজে উঠায় গান শোনার আনন্দের আমেজটুকু কেটে যায়। স্ক্রিনে ভেসে থাকা নামটি দেখে কিছুটা অবাক হয় সে । কল রিসিভ করে ওপাশের কথা শুনতে থাকে। ধীরে ধীরে কালো হয়ে যায় ওর মুখ। বিষাদে ছেয়ে যাওয়া অন্তর নিয়ে কেঁপে উঠা হাতে মোবাইলের লাল বাটনটি চাপে। একবারে হয় না। দু'বার চাপ দেয়া লাগে কলটি কেটে দিতে।
এই বৃষ্টিতে এখনই ওকে বের হতে হবে। যেতে হবে সেই গ্রামের শেষ মাথায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাতাটি কোথায় রেখেছে খুঁজতে থাকে পারুল।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১১০৬ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পারুলের পর্বটি ভালই, চরিত্র ও দৃশ্য গুলো প্রাণবন্ত। জানিনা পারুলকে কোন বেগম রোকেয়া বানিয়ে ফেলেন কিনা। অনেক ধন্যবাদ। বাকী পর্ব গুলোতে নজর রাখছি।
না, পারুলকে এক সাধারণ নারী-ই রেখে গল্প সামনে এগিয়ে নিতে চাচ্ছি। সাধারন তবে শ্রেনিসচেতন এক সুন্দর হৃদয়ের মহিলা।
ধন্যবাদ আপনার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
অনেক শুভেচ্ছা।
না, পারুলকে এক সাধারণ নারী-ই রেখে গল্প সামনে এগিয়ে নিতে চাচ্ছি। সাধারন তবে শ্রেনিসচেতন এক সুন্দর হৃদয়ের মহিলা।
ধন্যবাদ আপনার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
অনেক শুভেচ্ছা।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন